ব্লিডিং বরষে...
আমরা যে মারমার কাটকাটের মধ্যে বাস করছি, যে উত্তেজনা টেনশনে বৰ্তে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে 'ব্লিডিং বরষে হৃদি' সর্বার্থেই একশোয় একশো পাওয়ার যোগ্য, কবিতার পাঠক না পোছলেও সে সত্যিটা বদলাবার নয়।
রাহেবুলের দ্বিতীয় কাব্যি 'ব্লিডিং বরষে হৃদি'। অপ্রসঙ্গত সকলের অপরিচিত রাহেবুল প্রণীত প্রথম কাব্যি 'মদীয় ফ্যান্টাসি'! 😊
ব্লিডিং বরষে...
আমরা যে মারমার কাটকাটের মধ্যে বাস করছি, যে উত্তেজনা টেনশনে বৰ্তে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে 'ব্লিডিং বরষে হৃদি' সর্বার্থেই একশোয় একশো পাওয়ার যোগ্য, কবিতার পাঠক না পোছলেও সে সত্যিটা বদলাবার নয়।
রাহেবুল এর 'ব্লিডিং বরষে হৃদি' এক ব্যতিক্রমী পাঠ অভিজ্ঞতা।
একটার পর একটা কবিতা অতিক্রম করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন বিন্যাস আর প্রেজেন্টেশন থেকে।
প্রাথমিক ভাবে ধাক্কা বা ঝটকার গিমিক মনে হতে পারে কারো কারো। সেই ভ্রমও কেটে যাবে কিছুটা পথ এগোলে।
বইপাড়া বা বইমেলা বা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় খুঁজে নিয়ে কেনার মত বই।
অথচ, বইটি নাকি সহজলভ্য নেই আর।
ক্রৌঞ্চদ্বীপের টেবিলে পেয়েছিলাম। সম্ভবতঃ ওই পত্রিকার টেবিলেই এখনো পাওয়া যাবে।
বই থেকে একটি কবিতা এখানে রাখলাম।
ঝাণ্ডা
সময়
সু+সময়
দুঃ+সময়
অমন ক্ষণে লালন কয়ে উঠলো: সময় গেলে সাধন হবে না।
ডাণ্ডায় বাঁধা ঝাণ্ডাগুলান সমস্বরে
বলে উঠলো: ইনকিলাব
কতেক রামাল্লাহ্ আগের মতোই বোবাকালাকানা
রহিলেন
পাড়ার গুণ্ডা শুধালো: বাঞ্চোত! শাসকই
সময়! দেখিয়ে দোব
নাগরিকগণ পূর্বের মতোই পছন্দসই নাগর
পেল না আজও; তজ্জন্য—
ইমুজি ভেজলো মহার কাছে “যদি কিছু
লাভের রিয়্যাক্ট মেলে?”
প্রথম সংবাদ: মেলাতে ইবলিশ পত্রিকা থাকছে না।
দ্বিতীয় সংবাদ: মেলাতে রাহেবুলের 'মদীয় ফ্যান্টাসি' পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু সদ্যপ্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যি 'ব্লিডিং বরষে হৃদি' পাওয়া যাচ্ছে ('ক্রৌঞ্চদ্বীপ' পত্রিকার টেবিলে, টেবিল নং ২২)। আগ্রহী কেউ থাকলে উঁকি দিয়েন ও-টেবিলে।
সংবাদ সমাপ্ত হলো 😊
ব্লিডিং বরষে হৃদি। এক রক্তাক্ত হৃদয়ের উপাখ্যান। বমিসম্ভুত এক কাব্য। অনর্গল বিষাদ গলাধঃকরণের যেন ফলাফল এই কবিতা সমূহ রাশি। উৎসর্গ করা হয়েছে রু কে তিনি রা নামের সূয্যি দেবের কন্যা, স্ত্রী ফারহানা মানে আনন্দময়ী আর শেফালী এবং চৈতি। উৎসর্গ পত্রেও চূড়ান্ত রকমের ব্যতিক্রমী উদযাপন। হুবহু পড়তে গেলে বইটি কিনে পড়তে হবে। আর হ্যাঁ অবশ্যই এই বই ব্যতিক্রমী তাই স্বাদে মানে স্বোয়াদে একদম রাহেবুলীয় এক গাথা।
কবিতাগুলি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লেখা হয়েছে। ‘ঘূর্ণন দেখছি’র শেষ টা এখানে শুরু হয়েছে। সে এক বিজ্ঞাপন আগামী কাব্যির। কবিতাগুলি দু’হাজার উনিশের লেখা।
দ্বিতীয় কবিতা— ‘এইভাবে/এই ভবে/ব্ল্যার/ব্লেডজ কুসুম’
(এই বই পড়ুন ব্লেডজ কুসুম) ভুল করবেন না ‘ক্লেদজ কুসুম’ বলে। ইনি বোদলেয়ার নন আমাদের প্রিয় কবি যিনি প্রথম কবিতায় আমাদের রক্তাক্ত করেন দুমুখি ধারালো এক ব্লেডে।
দুই প্রেমিক প্রেমিকা অনুহ্য থেকেছে। তাদের সংলাপ বিরচিত হয়েছে। কি অসাধারণ কাব্যগুণ—
“ঘুম হয়েছে?
না।
ঘুম হয়েছে?
না।
ঘুম হয়েছে কাল?
না।
ঘুমিয়েছ কাল?
ততটা ভালো নয়।”
এরপর চলতেই থাকে দীর্ঘ কবিতাটি।
“সাদা পরির সম্মোহন
অথবা
সেক্সচ্যাট
অথবা
ব্লেডজ মায়া”
এই হচ্ছে রাহেবুলীয় প্রেমের সংজ্ঞা। যেখানে প্রেম নিয়ে কবিকল্পনা নেই। ঝর্ণা নেই। আছে শুধু শরীরি উত্তাপ আর চূড়ান্ত ভোগবাদী এক প্রজন্মের তুমুল সেক্সচ্যাট। যা স্বাভাবিক। রিয়েল এক পৃথিবীর ছবি তুলে ধরে যেখানে ভোর নেই শুধু ঘুমহীন অনন্তরাত।
একসময় রাষ্ট্র সমাজের পচন উঠে আসে কবি নিশ্চিন্ত স্বাভাবিক উচ্চারণ করেন—
“খাপ বসেছে ঘুমের নৈরাজ্যে। ঘুমের বীচিগুলান কেমন আমাছামা লাগে...কেমন ব্ল্যার… কীসব টক্সিসিটি, একসময় নিন্দালু হই।”
ক্লান্ত হতে হতেও কবি আমাদের শেষ ক’টি লাইনে আমাদের সমাজ সভ্যতার ‘ব্ল্যার’ ‘আমাছামা’ অংশটি তুলে ধরে আমাদের নিয়তি দেখিয়ে দেন অথবা সময়সচেতন কবি এখানেই নিস্তব্ধতার গান ফাঁদেন—
“ডাংঘড়ির কাটা যেন।
বলে-
পাগলা গারদে কবে যাবি?”
ভাষা, শব্দ নির্বাচনে কবি নির্মোহ। দেশীয় রাজবংশী শব্দ অবলীলায় ব্যবহার করেছেন। কবির তির্যক প্রতিবাদ সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতার সীমানাও পেরিয়ে গেছে। সমগ্র মানব সমাজ মানচিত্র হয়ে উঠেছে ব্যঙ্গের বিষাদের লক্ষ্যস্থ্ল এবং কারণ—
“উলঙ্গরা রাজা, রাজপাট তাহাদের।”
আবার অন্য কবিতায়—
“ডান্ডায় বাধা ঝাণ্ডাগুলান সমস্বরে বলে উঠলো: ইনকিলাব
কতেক রামাল্লাহ্ আগের মতোই বোবাকালাকানা রহিলেন
পাড়ার গুণ্ডা শুধালো: বাঞ্চোত! শাসকই সময়!”
শব্দের স্ফুরণ। অগ্নি। যা ক্রমাগত জ্বালিয়ে গেছে আমাকে। কবিতা পড়তে পড়তে বইটা বহুবার বন্ধ করে বুঝেছি এ আসলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আত্মসমালোচনা করার মতো যে এখুনি হয়তো বাথরুম থেকে ফিরে এসে নিজের ধোওয়া আধাধোওয়া প্রত্যেক্টি অংশ পচন দেখতে পাচ্ছে তাকে তুলে ধরছে শব্দ বাক্য কখনো নৈশব্দ্যঃ কখনো আবার স্পেসের মাধ্যমে। বস এই কবিতাগুলি পড়তে গেলে সাহস লাগবে। আর হ্যাঁ এই কবিতা হয় রাস্তায় পাগলের মতো দাঁড়িয়ে থুতু ছিটিয়ে সমাজ সভ্যতার ধর্মের গায় পাঠ করতে পারেন, হবে নতুবা চুপ করে আত্মস্থবির হয়ে যেতে হবে। উল্লেখ্য এই বইয়ে আরও দু’টো গদ্য রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আরও দীর্ঘ পরিসরের প্রয়োজন। আর হ্যাঁ বইটি বুকসেল্ফে রাখার জন্য নয়। যারা ব্যাতিক্রমী লেখা পড়েন তারা অবশ্যই সংগ্রহ করুন। আর হ্যাঁ বইটি আমাদের উপহার দিয়েছেন প্রকাশক আমাদেরই ভাইবেরাদর সুকান্ত দাস।
কবিতার প্রচ্ছদ খুব সুন্দর। করেছেন কৃষ্ণেন্দু নাগ।
প্রচ্ছদের রূপটান সুপ্রসন্ন কুণ্ডুর।
মূল্য আশি টাকা।
প্রকাশক শাঙ্খিক।

“সকলই বোধয় ফ্যান্টাসি...
হৃদি বরষে। ব্লিডিং বরষে। বরষে যায়...
স্বপন জাল বুনে, যথা মাকড়সার জাল...”
জাল বোনেন কবি রাহেবুল। সূত্র গেঁথে তোলেন, তাঁর প্রথম কাব্যি “মদীয় ফ্যান্টাসি” ও দ্বিতীয় কাব্যি “ব্লিডিং বরষে হৃদি”র ভেতর। বিনিসুতোয় এর বিচিত্র মালা গাঁথেন কবি। অলৌকিক প্রক্রিয়ায় “চুঁয়ে চুঁয়ে শরীর-মন-বোধ-বুদ্ধি-সত্তা থেকে নির্গত হয়ে চলে টক্সিসিটি, কবিতা।”
অবশ্য কবি না লিখলে কি সূত্র খুঁজে পাবেননা পাঠকেরা। শ্রীমান রাহেবুলের একনিষ্ঠ পাঠকমাত্রই সহজে অনুধাবন করতে পারবেন এই যোগসূত্র। অপেক্ষা ছিলই প্রায় দেড় বছর ধরে, এই কাব্যির জন্যে।
আসলে কবি সোজা পথে চলেন না কখনই। নাকি একটু বেশীই সোজা পথে চলেন! শব্দপ্রয়োগে ও ভাবনায় গড়নে পেটনে ভাঙচুর করা ওনার কলমজাত। কোনো পাঠক হঠাৎ করে পড়তে এলে হোঁচট খাওয়া অবশ্যম্ভাবী।
চেনা ফরম্যাটকে হাতের তালুতে গুঁড়ো গুঁড়ো করাই যদি রাহেবুলের ভবিতব্য হয়ে থাকে, তবে তা আলবত করেছেন উনি। বেশ করেছেন। আমরা পাঠকরা এঞ্জয় করি কবির কলম,
“চাঁদনি রাতি গো।
চামচিকা সকল বেরিয়েছে প্রণয়ে
ওয়েলিং জুড়ে ভ্যাম্পায়াররাজ।”
যতিচিহ্ন ব্যাবহারে অভিনবত্ব লক্ষণীয় গত কাব্যি থেকেই। একটু বেশীই তীব্র করে তোলে কি লেখনীকে!
“কে ঝুলিয়েছে এইসব দড়ি?
উচিত ছিল: তাঁর কথাই রাষ্ট্র হওয়া।”
অথবা
“সকল কাফেলা ডিম্বের খোঁজে,
কিংবা যেমতি পালটি খেলে মুখ বা মুখপাত্র: ডিম্ব কারে খোঁজে?”
রাহেবুল তাঁর রচনাকাল নির্ধারণ করেছেন শুরুতেই। একটা প্রবাহে পড়ে গেলে কিন্তু রচনাকাল গৌণ হয়ে যায়। কবির কলমে সে দম আছে বৈকি!
তীব্রতা আরও তীব্রতর হয় উপসংহারে। “বধ্যভূমিতে বসে বাধ্য হয়ে” লিখে যাওয়া কবি গদ্য ভাষায় লেখেন, “ইত্যাকার ঈশ্বরকণা বা পরমাণুকণা কারোরই খোঁজে যাইনি আমি কোনোদিন। অরিজিনালিও আমরা মৃত্যুবিলাসী ছিলাম... কেমন একটা তাগাদা, সেই শেষ বা শুরু, সেখানে পৌঁছোবার...”
শেষ হয়ে হইলনা শেষ: কেন লিখি। এক অনবদ্য জবানবন্দী। অবলীলায় লেখেন রাহেবুল, “এই বিগ বিগ ব্যাং-হরিণী-গরু-গিরগিটি-বেজি-ছুঁচোর মেহফিলে নূতন হই, উপজাই, লয় হয়, ক্ষয় হয়। প্রক্রিয়াটির নাম কবিতা। গিনিপিগটি আমি। হতে হতে স্বয়ং কবিতা হই। আর অহং কবি হয়।”
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: যেসব পাঠক কবিতাকে অচলায়তনের মত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে চান, তাঁদের এই বইটি না পড়াই ভালো!
শ্রীমান রাহেবুলের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
গ্রন্থ: ব্লিডিং বরষে হৃদি
প্রকাশক: শাঙ্খিক
প্রচ্ছদ: কৃষ্ণেন্দু নাগ
মূল্য: 80 টাকা
যোগাযোগ: +9195474 58178
| 'ব্লিডিং বরষে হৃদি'র মোড়ক উন্মোচনে কবি দেবজ্যোতি রায়, কবি সুবীর সরকার। |
| 'ব্লিডিং বরষে হৃদি'র মোড়ক উন্মোচনে কবি দেবজ্যোতি রায়, কবি সুবীর সরকার। |
৮ ডিসেম্বর ২০২১ আলিপুরদুয়ার ব্যবসায়িক সমিতির টাউন হলে সন্ধ্যাকালীন একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবি রাহেবুলের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ব্লিডিং বরষে হৃদি’র আনুষ্ঠানিক প্রকাশ সুসংঘটিত হল। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন অগ্রজ দুই কবি দেবজ্যোতি রায় ও সুবীর সরকার। অনুষ্ঠানটির আয়োজক 'ব্লিডিং বরষে'র প্রকাশক ‘শাঙ্খিক’ তথা তার কর্ণধার কবি সুকান্ত দাস।
কথা হচ্ছে ‘ব্লিডিং বরষে’কে নিয়ে। ২০১৯-এই বইটি বেরনোর কথা ছিল। কিন্তু তা আর হলো কই? এভাবে কুড়ি এল। কিন্তু প্রকাশক পেলাম না। অবশেষে এক প্রকাশক পেলাম, ‘ক্রৌঞ্চদ্বীপ’, কিন্তু দু'হাজার কুড়ি পেরিয়ে গেল, নানা কারণে তাদের পক্ষে বইটি প্রকাশ করা হয়ে উঠলো না আর। একুশে এসে ‘শাঙ্খিক’ বইটা করতে চাইল। ঢিমে তালে চলতে চলতে বছর গেল। অবশেষে একুশের শেষে ‘ব্লিডিং বরষে’ বই হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল।
মাঝে ‘ক্রৌঞ্চদ্বীপ’-এর সঙ্গে বার্তালাপের সময় ‘ক্রৌঞ্চদ্বীপ’-এর সম্পাদক কাম প্রকাশক স্নেহাশিস রায় বইটির খসড়া পিডিএফ আকারে পড়তে দিয়েছিলেন কবি সমীরণ ঘোষকে। কবির সায়েই প্রকাশক বইটি করতে বিশেষ আগ্রহী হন। যদিও শেষমেষ বইটি আর বেরয় না। এবং কবি সমীরণ ঘোষের প্রতিক্রিয়াও বিস্তারিতভাবে বা লিখিত আকারে পড়ার সুযোগ হতে বঞ্চিত হতে হয়। পরবর্তীতে বইটির পিডিএফ-খসড়া নিজ উদ্যোগে আমি কবি ও গদ্যকার দেবজ্যোতি রায়কে দিই। ইচ্ছে ছিল তেমন হলে বইটির মুখবন্ধ বা ব্যাক কভারে কবির মূল্যবান নিরীক্ষণ ব্যবহার করার। কিন্তু সে সময়ে কবির মোবাইল ফোনে সমস্যা থাকায় তাঁর আর পড়া হয়ে ওঠেনি খসড়া। এবং আমারও অপ্রাপ্তি হিসাবেই থেকে যায় বইটির সম্পর্কে হতে পারার মতন একটি মূল্যবান মত। যাক গে। বাকিরা এখন কে কীভাবে নিচ্ছেন বইটিকে সে জানতে পারাটাই অনেকখানি। বইটি কিনতে চাইলে যোগাযোগ: +9195474 58178।
—রাহেবুল।
রাহেবুলের কবিতা নিয়ে বিশেষত সদ্য প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যি 'ব্লিডিং বরষে হৃদি' নিয়ে তরুণ কবি নীলাদ্রি দেব এই শীতের মরশুমে যে-মতন কাতর ...